অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস হলেও দেশে ব্যবসার পরিবেশ স্বাভাবিক না হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিল্পাঞ্চলে অসন্তোষ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের মতোও ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিক কারখানায় যেতে ভয় পাচ্ছেন। এ রকম ভীতিকর পরিবেশ ব্যবসা ও অর্থনীতির জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়।
গত শনিবার (৫ অক্টোবর) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত সেমিনারে দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবসার পরিবেশ উন্নতি করার যে দাবি জানিয়েছেন, সেটা সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। কেননা, শুধু প্রবাসী আয় ও দাতাদের ঋণসহায়তায় দেশের অর্থনীতি সচল থাকবে না, বাড়বে না কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি।বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ নিরাপদ ও উন্নত না করতে পারার পেছনে বাধা কোথায় এবং ব্যবসার পরিবেশ কীভাবে উন্নত করা যায়, তা নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ তুলে ধরেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের ক্রমাগতভাবে অবনতি হওয়ার তথ্য উঠে আসছিল। এ রকম পরিবেশ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আসার জন্য অনুকূল নয়।
আমলাতান্ত্রিকতা, রাজনৈতিক প্রভাব ও ঘুষ-দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে দেশের ব্যবসার পরিবেশ সহজ ও উন্নত করার দাবি দেশের সৎ-নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের। বিগত হাসিনা সরকারের আমলে সরকারের যে নীতি ছিল, সেখানে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুষ্টিমেয় কিছু গোষ্ঠী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সীমাহীন সুবিধা পেয়েছে। এই গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা, যাঁরা প্রতিযোগিতামূলক শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখতে চান, তাঁরা কোণঠাসা ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের শিল্প খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গোষ্ঠীতন্ত্রের অচলায়তন ভাঙার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
দীর্ঘ স্বৈরশাসনে যেভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে, তাতে জঞ্জাল সরিয়ে সবকিছুকে ঠিকমতো সচল করা অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে কঠিন এক যাত্রা। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। ফলে ব্যবসা ও শিল্প–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাঁদের কথা শোনার কোনো বিকল্প নেই।
সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে তাঁরা দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা ও গ্যাস–সংকটের কারণে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শ্রমিক অসন্তোষের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে তাঁরা শিল্পাঞ্চলে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন।
ডিসেম্বর তৈরি পোশাকশিল্পের ভরা মৌসুম, কিন্তু শিল্পাঞ্চলের অস্থিতিশীলতার কারণে ক্রেতারা ইতিমধ্যে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছেন। উদ্বেগজনক এই বাস্তবতার কারণে যেকোনো মূল্যে শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা প্রয়োজন। তৈরি পোশাকশিল্প ঘিরে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, সেটাও বের করা জরুরি। তবে মজুরি, সুযোগ-সুবিধা ও কাজের পরিবেশ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নে স্বল্পমূল্যে আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার যে দাবি জানিয়েছেন, সেটাকে আমরা ইতিবাচক বলে মনে করি।
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেটাকে স্বাগত জানিয়ে রাজস্ব খাতে সংস্কারের নজর দেওয়ার কথা ব্যবসায়ীরা বলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, কাস্টম হাউসগুলোর দুর্নীতির কারণে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ‘ঠিক জায়গায় ঠিক লোককে বসালে ভালো ফল দেয়’—বলে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর যে মন্তব্য করেছেন, সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।